লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তম (১৯৩৬-১৯৮১) ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি স্বাধীনতার ঘোষক ও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হন। তিনি বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করেন এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে সংজ্ঞায়িত করেন।
সেনাবাহিনীতে জীবন
জিয়াউর রহমান ১৯৫৫ সালে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন লাভ করেন। তিনি দুই বছর পাকিস্তানে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৫৭ সালে তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন। ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি সামরিক গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করেন। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে তিনি কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে খেমকারান সেক্টরে যুদ্ধ করেন। আশ্চর্যজনকভাবে তার কোম্পানি যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ পারফরম্যান্সের জন্য সর্বাধিক গ্যালান্ট্রি অ্যাওয়ার্ড লাভ করে। ১৯৬৬ সালে তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। একই বছরে তাকে কোয়েটার স্টাফ কলেজে ‘কমান্ড’ কোর্সে পাঠানো হয়। ১৯৬৯ সালে তিনি বাংলাদেশের জয়দেবপুরে সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে দ্বিতীয় ইন-কমান্ড হিসেবে যোগ দেন। তিনি পশ্চিম জার্মানিতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালে দেশে ফিরে মেজর পদে চট্টগ্রামের অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে দ্বিতীয় ইন-কমান্ড হিসেবে যোগদান করেন।
মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানি সেনারা তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় এবং ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা চালায়। ইতিহাসের এই ভয়াবহতম গণহত্যা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পরিচিত।
মেজর জিয়াউর রহমান ২৫শে মার্চ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এরপর ২৬শে মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বেতার কর্মীদের সহায়তায় স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। তিনি বলেন— “আমি মেজর জিয়া, বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনীর অস্থায়ী প্রধান সেনাপতি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।” মুক্তিকামী জনতার মানসিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে এই ঘোষণা ছিল অত্যন্ত প্রভাবশালী।
জিয়াউর রহমান ও তার সৈন্যরা মুক্তিযুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা নেন। কয়েকদিন চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখার পর পাকিস্তানি বাহিনীর চাপে কৌশলগতভাবে সীমান্ত অতিক্রম করেন।
প্রথমে তিনি বাংলাদেশ বাহিনীর ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার হন এবং জুন থেকে ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ও জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে জেড ফোর্স ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২৮ আগস্ট ১৯৭১ সালে তিনি রৌমারীতে প্রথম অসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করেন, যা মুক্ত এলাকা হিসেবে পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে পুনর্দখল করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তাকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বীরত্ব পদক ‘বীর উত্তম’ প্রদান করা হয়।
বাংলাদেশ রাজনীতিতে অনিবার্য উত্থান
নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকার পর জিয়াউর রহমানকে কুমিল্লার ব্রিগেড কমান্ডার করা হয়। ১৯৭২ সালের জুনে তিনি বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর উপপ্রধান হন। ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নীত হন এবং বছরের শেষে মেজর জেনারেল হন। ১৯৭৫ সালের ২৫ আগস্ট তিনি সেনাপ্রধান হন। ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে খালেদ মোশাররফ ও শফাত জামিলের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান হলে তাকে পদত্যাগ করে গৃহবন্দি হতে হয়। তবে ৭ নভেম্বর ‘সিপাহী-জনতা বিপ্লব’-এর মাধ্যমে তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রে ফিরে আসেন।
৭ নভেম্বর সেনাপ্রধান হিসেবে পুনর্বহাল হন। একই দিনে সেনা সদর দপ্তরের বৈঠকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয়, যেখানে বিচারপতি এএসএম সায়েম প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং মেজর জেনারেল জিয়া, এয়ার ভাইস মার্শাল এমজি তাওয়াব ও রিয়ার অ্যাডমিরাল এমএইচ খান উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন। ১৯ নভেম্বর ১৯৭৬ সালে সায়েম পদত্যাগ করলে জিয়া প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন এবং ২১ এপ্রিল ১৯৭৭ সালে সায়েম রাষ্ট্রপতির পদ ছাড়লে তিনি রাষ্ট্রপতি হন।
তিনি ক্ষমতায় এসে দ্রুত আইন-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ নেন এবং পুলিশ বাহিনীর আকার ৪০,০০০ থেকে ৭০,০০০ জনে উন্নীত করে তাদের সঠিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যও কঠোর পদক্ষেপ নেন। এ সময় কিছু বিদ্রোহ ও অভ্যুত্থান ঘটলেও তিনি তা কঠোরভাবে দমন করেন।
দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক
রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার পর তিনি সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ যুক্ত করেন এবং ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ নীতিগতভাবে সংযোজন করেন। ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮ সালে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করেন এবং দলের চেয়ারম্যান হন। ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারির সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ৩০০ আসনের মধ্যে ২০৭ আসন জয়লাভ করে। ৯ এপ্রিল ১৯৭৯ সালে সামরিক আইন প্রত্যাহার হয়।
তিনি ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ ধারণা প্রচলন করেন, যা ধর্ম, জাতি, বর্ণ বা সংস্কৃতি নির্বিশেষে ভূখণ্ডের ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্যের ওপর গুরুত্ব দেয়। রাজনৈতিক দলগুলোকে পুনরায় সক্রিয় হতে দেন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেন এবং শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।
অর্থনৈতিক সংস্কার
রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি বেসরকারি খাত উন্নয়নে গুরুত্ব দেন, কৃষি খাতে ভর্তুকি দেন, রপ্তানি খাত সম্প্রসারণ করেন এবং অনেক রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প পুনরায় মালিকদের হাতে ফিরিয়ে দেন। তার ১৯ দফা কর্মসূচি কৃষি বৃদ্ধি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ এবং গ্রামীণ উন্নয়নে অংশগ্রহণের ওপর জোর দেয়।
তার আমলে খাদ্য উৎপাদনে রেকর্ড বৃদ্ধি, ১৫০০ খালের খনন ও পুনঃখনন, দু’বছর ধারাবাহিক খাদ্য শস্য উৎপাদনের সাফল্য এবং গড় জিডিপি ৬.৪% বৃদ্ধি ঘটে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভূমিকা
তিনি প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক জোরদার করেন। চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নত করেন। তার প্রচেষ্টায় দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়, যা ১৯৮৫ সালে ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়।
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি নিহত হন। তাকে ঢাকার শেরেবাংলা নগরে সমাহিত করা হয়।